অকৈতব

কাজী মনির-এর একক চিত্র প্রদর্শিনী, কিউরেশন: মোস্তফা জামান

July 12-25, 2024, Dwip Gallery

অকৈতব : কাজী মনির-এর একক চিত্র প্রদর্শিনী

১.

এই প্রদর্শিনী কিছু অকৈতব বা অকৃত্রিম দৃশ্যসমূহ দর্শক সমীপে তুলে ধরবার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস। শিল্পীর আপন দ্বীন অনুসরণে অর্জন করা ছবি ‘খাঁটি সোনা’ হিসেবে চেনা সহজ। শিল্পভাষার সহজতা ও অকপটতার মধ্যে তা সুনির্দিষ্টভাবেই চিহ্নিত। সহজতার সূত্রে খাঁটি সোনা গড়বার এই কারিগরের নাম কাজী মনির (১৯৫২-২০০৮)। দেহত্যাগের আগেই  তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তাঁর নতুনতর পদ্ধতিতে গড়ে তোলা চিত্রকল্পের জন্য। বৃহত্তর সুধীমহলে তাঁর অনুপ্রবেশ সম্ভব হয় নাই। কিন্তু যারা তাঁর কাজের মধ্যে উপরোল্লেখিত অকৈতব বা অকৃত্রিম এক মাত্রার দেখা পেয়েছেন, তাঁরা মোহিত হয়েছেন, নিজেদের নাগরিক পরিশীলিত পরিসরে এমন ‘আদ্যারূপে’ উৎসাহী শিল্পীর অনুপ্রবেশে হয়েছেন আপ্লুত। 

মনে রাখা জরুরি যে, এই  প্রদর্শিনী কাজী মনির-এর উদ্ভাবনী শক্তির সামান্য উদযাপন মাত্র। স্বশিক্ষিত এই শিল্পী হাজার হাজার ছবি এঁকে রেখে গেছেন। তাঁর শক্তিমত্তার কিয়দংশ এখানে চাক্ষুষ করে তুলে শিল্পের শরীর ও আত্মা বিষয়ে যদি কিছু আলাপের সূচনা করা যায় তা এই আয়োজনের বাড়তি পাওনা।  

রং, রেখা ও বিন্যাসের কোনো নিজস্ব মাত্রা অর্জনের তাগিদে কাজী মনির ছবি আঁকেন নাই। বরং ভিশনের বা কল্পদৃষ্টির আওতায় যে রূপ জন্ম লয়, যা চিত্রভাষা থেকে মুখের ভাষায় তর্জমা করে  ‘আদ্যরূপ’ বা আদিরূপ হিসাবে ব্যাখ্যা করা চলে। কারণ ভৌতপ্রকৃতি যখন মানবের আদীম প্রকৃতির সাথে মেলে, কেবল তখনই বাস্তব জগতের অধিক মানুষ দেখতে আগ্রহী হয়। এই বাড়তি দেখা ও দেখাবার শিল্পীই  কাজী ছিলেন ছিলেন মনির। তিনি দেহ ত্যাগ করেছেন, রেখে গেছেন অমূল্য সব চেতনে-অচেতনে উজ্জীবিত হবার বা সজাগ থাকবার খোরাক। ঘুমন্ত চেতনের বিপরীতে তিনি ছিলেন সজাগ চেতন বা সাক্ষী চেতনের শিল্পী ।              

২. 

কাজী মনিরের জন্ম ১৯৫২ সালে । ফেনী জেলার ফুলগাজী থানার সুরপুর নামের অজপাড়াগাঁয়ের এক দারিদ্র কৃষক পরিবারের এই সন্তান শৈশবে নানান প্রতিকুলতার মুখে অষ্টম শ্রেণীর পর পড়ালেখার ইতি টানতে বাধ্য হন। জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে তিনি নানান জীবিকায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। এক পর্যায় তিনি পুরানো পত্রিকা কেনাবেচা করে জীবন ধারণে ব্রতী হন। কিন্তু স্বভাবে যিনি শিল্পী, এমন সাধারণ কাজের পাশাপাশি ছবি আঁকা শুরু করেন। পরিত্যাক্ত ক্যালেন্ডার কিংবা পোস্টারের পিছন দিকে রং লেপে কাজী মনির তার আপন জগত রচনা করেন। আশির দশকে ফুটপাতে বসে তার এইসব প্রাকৃতিক দৃশ্য-সুলভ কাজে অতিপ্রাকৃতবোধ যেন বেহেস্তের বাগানের কথা মনে জাগায়। মানব সৃষ্টির ধর্মীয় কাহিনীর মুলে মানব মনের যে স্বস্থ এক অতীতের গল্প জীবনের অনিশ্চিত যাত্রাপথে মানুষের মানবীয় আকাঙ্খাসমূহ বাঁচিয়ে রাখে, হয়তো অমন আকাঙ্খার তাগিদে এই স্বশিক্ষিত শিল্পী একের পর এক চিত্র রচনা করে গেছেন।  

৩.

এখানে কিছু তত্ত্বকথার দ্বারস্থ হওয়ার বিকল্প নাই। মহাকবি গ্যেটে যখন মনোযোগের সাথে প্রকৃতি দর্শন করে তার খুঁটিনাটি লক্ষ্য করে আলোক বিষয়ে তার আপন তত্ত্ব লেখেন ততদিনে বিজ্ঞানী নিউটনকৃত রঙের স্পেকট্রাম বিষয়ক আবিষ্কার বিজ্ঞান হিসেবে গৃহীত হয়েছে। তথাপি গ্যেটে সব রঙের পিছনে সাদা রঙের উপস্থিতির কথা বললেন। এনলাইটেনমেন্টের সে যুগে তিনি যা বোঝাতে চাইলেন তা তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজে প্রচলিত ‘মেকানিকাল’ চিন্তাপদ্ধতির বিপরীত এক অধ্যাত্ম ঐক্যের দিকে নির্দেশ করে। ‘প্রকৃতি’ অভিধার মধ্যে দিয়ে যে বাস্তব জগৎ তখন বিজ্ঞানের মধ্যস্থতায় খন্ড খন্ড হয়ে জ্ঞান হিসেবে হাজির হচ্ছে, তা নাকচ করে ঐক্যের একটি সূত্র চিহ্নিতকরণের মধ্যে দিয়ে গ্যাটে একত্বের আদপ মেনে চলতে চাইলেন। এমন একত্বের ধারণার মধ্যে থেকেই মানুষের আদ্য পরিচিয়ের প্রশ্নটি সামনে চলে আসে, যা লালন ফকিরের গানে ‘খোদ আমি’, কিংবা ‘আদম সফির আদ্যকথা’ হিসাবে হাজির হয়। যখন ফকিরি তত্ব অনুসারে লালন লিখেন : ‘জাহের বাতেন যে জানেনা / তার মনেতে প্যাঁচ পড়েছে’, তখন যা সামনে হাজির আছে যার যা অনুপস্তিত, এই দুইয়ের মধ্যে ঐক্যের ধারণার কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন। ঐক্যের ধারণা থেকে পতিত মানুষের কথাই লালন বার বার বলেন। 

প্রশ্ন হলো, এমত তত্বকথা কাজী মনিরের ছবি দেখতে পাওয়া কি প্রয়োজন ? সংস্কৃত থেকে গৃহীত ‘তত্ব’ শব্দের অর্থ যদি হয় ‘সত্য’ বা ‘বাস্তবতা’, তবে তা চোখের জ্যোতিবর্ধক । কাজী মনির যেসব চিত্র রচনা করে গেছেন সেসব সৃষ্টি কোনো সাধারণ দুনিয়াদারীর নিমিত্তে জন্ম নেয় নাই, এমনটা দাবি করা চলে। তাঁর চিত্রকল্প কোনো প্রচলিত প্রথা বা পদ্ধতি অনুশীলনের ফল নয়। এর ভিন্ন মজেজা রয়েছে — যা খেয়াল করতে মানব মনের ‘আদ্যচেতন’-এর স্থানটি নির্দিষ্ট করে বুঝতে পারা   জরুরি। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ‘অচেতন’ বা ‘প্রাইমাল সিন’ বা খোদ দৃশ্য অপেক্ষা এখানে ‘আদ্যচেতন’ কিংবা ‘আদ্যরূপ’ অথবা ‘আদ্যপরিচয়’ বিষয়ক ধারণা অনেক বেশি খাটে। পরমার্থ সন্ধানী এই শিল্পীর শিল্প বিষয়ে সহি আলোচনা এছাড়া হয়তো অসম্ভব।


মোস্তফা জামান

শিল্পী, সমালোচক, কিউরেটর