Bodyspace/Mindscape

Wakilur Rahman

May-3-31, 2019, Dwip Gallery, 1/1, Block D (g floor), Lalmatia, Dhaka

খণ্ডকালীন সময়ের ওয়াকিল

স্বকীয়া ও পরকীয়া — এই দুয়ের সমন্বয়ে শিল্পের জগত। যা কিছু আপনার তার মধ্যে অপরের বিষয়-আসয় বা চরিত্রের মিলন ঘটে বলেই শিল্পের পরিসর জঙ্গম, চিত্রভাষা বিবর্তণশীল। ওয়াকিলুর রহমানের আশির দশকের শেষ পর্বের কাজে স্বকীয়া ভাব যে যে পরকীয়া চিত্রকল্পের সূত্রে গড়ে উঠেছে, তা সহজে পাঠ করা যায়। যেমন, বলা চলে পশ্চিমবঙ্গীয় ধারার মানব অবয়ব অন্তঃর্মূখী কিছু শিল্পীর হাতে এক পর্যায়ে যে চরিত্র অর্জন করেছে, তার সাথে শিল্পী শহীদ কবিরের প্রথম দিকের কাজের অনুপ্রেরণা যুক্ত হয়েছে। 

শিল্পীর ভাষ্য থেকে যেমন আমরা এসব সূত্রের খোঁজ পাই, তেমন যে অবয়রধর্মীতার সূত্রে তিনি নিজেকে শিল্পী হিসাবে গড়ে তুলেছেন, তা থেকেও তার সে সময়কার কাজে অপরের সাথে মিলবার আয়োজন চিহ্নিত করা যায়।

অবয়ব স্বভাবতই নিরাবয়ব বিষয়ের সাথেও সম্পর্কিত। পূর্ব বার্লিনে যখন ছোট্ট এক কুঠুরিতে বসে শিল্পী ছোট আয়তনের কাজগুলোতে রূপ ফোঁটাতে আপন আইডেনটিটি বিষয়ে ছিলেন সজাগ, তখন লালনের গান, ভাওয়াইয়া ও আরো আরো বাংলা গান ছিল তার অনুপ্ররণা।

শিল্পীর ভাষ্য অনুযায়ী — ‘আগে জানলে তোর ভাঙ্গা নৌকায় চড়তাম না’র মতো গানের কলি থেকে তিনি নৌকার ধারণায় পৌঁছান। নৌকা ও পারাপার — এই দুইয়ের মিশ্রণে যে মেটাফিজিক্স বা জীবন-জিজ্ঞাষার জন্ম, তার মাঝে দেখা ও অদেখা দুইই হাজির থাকে।

শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান চীন দেশে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে, সহপাঠি এক বার্লিন কন্যার প্রেমে পড়ে বিভাজিত ইউরোপের পূর্ব জার্মানির রাজধানীতে দাম্পত্ব শুরুর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার মধ্য দিয়ে এক কঠিন পুলসিরাত পার হচ্ছিলেন। ঢাকার অদুরে সাভারে বেড়ে ওঠা শিল্পী হয়তো সেই ট্র্যানজিশন বা পরিবর্তনমূখী সময়ের (১৯৮৯-১৯৯১) দোলাচল তার কাজের মধ্যে প্রকাশ করেছেন। অবয়বের অধিক যে অবয়ব — যা শূণ্যতা সম্পির্কিত — তার বিস্তার এই ছবিগুলোর মধ্যে মানব অস্তিত্ব বিষয়ক অনিশ্চয়তা, গভীর ভাব ও অতৃপ্তির চিহ্নে পরিনত। যেমন দেহে, বিশেষ করে মুখোম-লে কালো বিবর ফুটে উঠেছে। ‘দেহজমি/মনোভুমি ৯’ যেন এই শূণ্যতা দেহকে অপরিচিত করে তুলেছে। ‘দেহজমি/মনোভুমি ২১’ শিরোনামের কাজে পেট, পাঁজর, স্তন যেন বিবরের বিস্তারের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।

বিমানবিকীকরণের যে ধরণ ‘দেহজমি/মনোভুমি’ শিরোনামের বর্তমান প্রদর্শণীতে শিল্পী দর্শকসমীপে পেশ করেছেন, তা একটি সময়ের কার্য্যক্রম বা যজ্ঞ মাঝে জানালা খুলে ধরে। দর্শক হিসাবে আমরা বুঝতে পারি যে ওয়াকিলুর রহমান পরিচয়ের রাজনীতি মূখ্য নয়, বরং সুদূর প্রবাসে বসে নিজ ভুমির কিছু অমূল্য অর্জন পাথেয় গণ্য করে ছবি আঁকতে শুরু করেন।

দেহ যে খাঁচা বা ঘর, তার ধারণা লালন অচীন পাখির সূত্রে শ্রোতার সামনে হাজির করেছেন। তারই ইন্টারপ্রিটেশন ঢাকায় প্রথম শহীদ কবির তাঁর টেম্পারার কাজে সত্তর দশকের প্রদর্শণীতে হাজির করেন। ওয়াকিলুর রহমান দ্বিতীয় শিল্পী যিনি এই বিমূর্ত ধারণার মূর্ত প্রতীক নির্মাণে হাত দেন। চিত্রীর/চিত্রের বিষয় তুলে ধরার আকাঙ্খা অনেক সময় শিল্পের নির্দিষ্ট কোন ভাষার ‘সীমা’ বা ‘অপরিমেয়তা’ সম্পর্কে শিল্পীকে সচেতন করে তোলে। হয়তো এ-কারণেই কিছু কাজ বিমূর্ততামূখী।

শিল্পীর এই প্রদর্শণী তার কাজের পরম্পরা বিষয়ে কতটা জ্ঞান দেবে সে বিষয়ে মন্তব্য না করেও বলা যায় এই কাজগুলো ইউরোপে ওয়াকিলুর রহমান নামের বাঙালি যুবকের জীবন শুরু করার আয়োজনের প্রথম খোরাক।

–মোস্তাফা জামান

 

শিল্পীর কথা

১৯৮৮ সালের শেষের দিকে তৎকালীন পূর্ব বার্লিনে আমার প্রবাস জীবন শুরু হয়। জার্মান ভাষাতে ছিলাম অজ্ঞ, নৃত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাও ছিল না। ইউরোপীয় শিল্পকলার ইতিহাস সম্পর্কে পুস্তকনির্ভর তথ্য ও জ্ঞান নিয়ে বিখ্যাত জাদুঘরগুলোতে ঘুরে বেড়াই, দেখতে থাকি।

ঐতিহ্য, আত্ম পরিচয়, আমাদের শিল্প, আমার শিল্প ইত্যাদি বিষয়ে সংকট ও উত্তরণ সংক্রান্ত চিন্তা-ভাবনা আগে থেকেই ছিল। বন্ধু-বান্ধবহীন সেই নতুন ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে যা কিনা আরো প্রকট হয়ে ওঠে।

ভারতীয় দর্শন, বাউল ও অন্যান্য লোকায়িত, সনাতন ভাবনাগুলো আকৃষ্ট করতে থাকে। মিনিয়েচার, পট, সরা, তান্ত্রিক শিল্পের গঠন, ভাষা, উপস্থাপনা নজরে আসতে থাকে। শিক্ষক, শিল্পী শহিদ কবীর ও গণেশ পাইনের চিত্র অভিজ্ঞতা উৎসাহিত করে। ছোট পরিসরে, স্বল্প উপকরণে এই ছবিগুলো আমার শিল্প চর্চার পথে খোঁজাখুঁজি, খোঁড়াখুঁড়ির একটি পর্যায়। ছবিগুলো ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সালে বার্লিনে আঁকা।

–ওয়াকিলুর রহমান